কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে বিপুল প্রাণহানির দায় প্রধানত সরকারের বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা। তাঁরা বলছেন, ভয় দেখানোর সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে হবে সরকারকে। গুলি করে আন্দোলন দমানোর অসুস্থ মানসিকতার অবসান এখনই করতে হবে। স্বাধীন দেশে মানুষ মুক্ত পরিবেশে বসবাস করবে; কোনো বদ্ধ, নিয়ন্ত্রিত ও আতঙ্কের পরিবেশে নয়।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘হত্যা, অবৈধ আটক ও নির্যাতনের বিচার চাই’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের এমন মনোভাব তুলে ধরেন বিশিষ্ট নাগরিকেরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, মানবাধিকারকর্মী শিরীন হক, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন ও আসিফ নজরুল। আরও ছিলেন বেসরকারি সংস্থা এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা।
‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর ব্যানারে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। লিখিত বক্তব্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্র–জনতাকে হত্যা, জুলুম ও নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে এমন গুমোট ও সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ এবং সামগ্রিকভাবে শিক্ষাঙ্গনকে নিরাপদ ও শিক্ষামুখী রাখতে ১১ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে পুলিশ, র্যাবসহ সরকারি বাহিনী এবং সরকারি মদদপুষ্ট অস্ত্রধারীদের গুলি ও নির্মম আঘাতে প্রতিটি মৃত্যুর সঠিক, স্বচ্ছ তদন্ত করা এবং প্রকৃত দোষী যত উচ্চ পদাধিকারী বা যে দলমতের হোক না কেন, তার সর্বোচ্চ আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করা।
দাবিগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্রের ব্যবহার ও বলপ্রয়োগের বিষয়ে জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে তদন্ত করা। ইতিমধ্যে সংগৃহীত ছবি, ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে চিহ্নিত সব হন্তারক ও আক্রমণকারীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা, এ ব্যাপারে দেরি করার কোনো সুযোগ নেই। নিহত ও আহত নাগরিকের পূর্ণাঙ্গ তালিকা সরকারকে অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে। দায় মেনে নিয়ে প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করা, আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং অঙ্গ হারানো সব নাগরিকের পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্ট নাগরিকেরা।
আটক ও গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তি দাবি
আটক ও গ্রেপ্তার করা সব শিক্ষার্থীকে অবিলম্বে মুক্তির দাবি এবং শিক্ষার্থী গ্রেপ্তারের চলমান প্রক্রিয়া বন্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে সংবাদ সম্মেলনে। একই সঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্রধারী ও প্রভাব বিস্তারের রাজনীতি বন্ধ করতে বলেছেন বিশিষ্ট নাগরিকেরা। তাঁরা বলেছেন, তথাকথিত ডিবি হেফাজতে জোর করে উঠিয়ে নেওয়া বা বেআইনি হেফাজতের ব্যাখ্যা দেওয়া এবং এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে জবাবদিহির মুখোমুখি করতে হবে।
‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর প্রতিনিধিদের তোলা দাবির মধ্যে আরও রয়েছে ভয় দেখানোর সংস্কৃতি থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। স্বাভাবিক ও স্বস্তির পরিবেশ নিশ্চিত করতে কারফিউ ও সেনা প্রত্যাহার, সাঁজোয়া যান সরিয়ে নেওয়া, হেলিকপ্টারের পাহারা থামানো এবং ব্লক রেইড, গণগ্রেপ্তার ও ছাত্র-অভিভাবক হয়রানি বন্ধ করতে হবে। অবাধ তথ্যপ্রবাহে আরোপিত সব বাধা দূর করতে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পূর্ণমাত্রায় খুলে দিতে হবে। সহিংসতা দমনের নামে বিরোধী মত দমন করা যাবে না।
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘এমন নির্মম হত্যাযজ্ঞের ও বলপ্রয়োগের নিন্দা, ধিক্কার বা প্রতিবাদের উপযুক্ত ভাষা আমাদের জানা নেই। এই বিপুল প্রাণহানির দায় প্রধানত সরকারের। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর যে মাত্রায় বলপ্রয়োগ ও সন্ত্রাসী কায়দায় আক্রমণ করা হয়েছে, তা দেশের জনগণ ও বিশ্ববিবেককে স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত করেছে।’